শবে বরাত ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা : পর্ব-১

শবে বরাত ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা : পর্ব-১

Author:
Price:

READ MORE

রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে



শবে বরাত  প্রাসঙ্গিক ভাবনা : পর্ব-
লেখক :-  মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম
সহকারী অধ্যাপকইসলামিক স্টাডিজ বিভাগউত্তরা ইউনিভার্সিটি,ঢাকা

শবে বরাতএর অর্থ
শবএকটি ফারসী শব্দ এর অর্থ রাত। ‘বারায়াতকে যদি আরবী শব্দ ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদ,পরোক্ষ অর্থে মুক্তি। যেমন কুরআন মাজীদে সূরা বারায়াত রয়েছে যা সূরা তাওবা নামেও পরিচিত। ইরশাদ হয়েছে :
بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ   .
আল্লাহ  তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা।”[1] 

এখানে বারায়াতের অর্থ হল সম্পর্ক ছিন্ন করা। ‘বারায়াতমুক্তি অর্থেও আল-
কুরআনে এসেছে যেমন :
أَكُفَّارُكُمْ خَيْرٌ مِنْ أُولَئِكُمْ أَمْ لَكُمْ بَرَاءَةٌ فِي الزُّبُرِ .
তোমাদের মধ্যকার কাফিররা কি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠনা কি তোমাদের মুক্তির সনদ রয়েছে কিতাবসমূহে?”[2]
আর ‘বারায়াতশব্দক যদি ফারসী শব্দ ধরা হয় তাহলে উহার অর্থ হবে সৌভাগ্য। অতএব শবে বরাত শব্দটার অর্থ দাড়ায় মুক্তির রজনী,সম্পর্ক ছিন্ন করার রজনী। অথবা সৌভাগ্যের রাত,যদি ‘বরাতশব্দটিকে ফার্সী শব্দ ধরা হয়
শবে বরাত শব্দটাকে যদি আরবীতে তর্জমা করতে চান তাহলে বলতে হবে ‘লাইলাতুল বারায়াত এখানে বলে রাখা ভাল যে এমন অনেক শব্দ আছে যার রূপ বা উচ্চারণ আরবী  ফারসী ভাষায় একই রকম,কিন্তু অর্থ ভিন্ন
যেমন ‘গোলামশব্দটি আরবী  ফারসী উভয় ভাষায় একই রকম লেখা হয় এবং একইভাবে উচ্চারণ করা হয়। কিন্তু আরবীতে এর অর্থ হল কিশোর আর ফারসীতে এর অর্থ হল দাস
সার কথা হল ‘বারায়াতশব্দটিকে আরবী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ বা মুক্তি। আর ফারসী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সৌভাগ্য

আল-কুরআনে শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই
শবে বরাত বলুন আর লাইলাতুল বারায়াত বলুন কোন আকৃতিতে শব্দটি কুরআন মাজীদে খুজে পাবেন না। সত্য কথাটাকে সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় পবিত্র কুরআন মাজীদে শবে বরাতের কোন আলোচনা নেই। সরাসরি তো দূরের কথা আকার ইংগিতেও নেই
অনেককে দেখা যায় শবে বরাতের গুরুত্ব আলোচনা করতে যেয়ে সূরা দুখানের প্রথম চারটি আয়াত পাঠ করেন। আয়াতসমূহ হল 
حم وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ.
হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমিতো এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। আমি তো সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়।”[3]
শবে বরাত পন্থী আলেম উলামারা এখানে বরকতময় রাত বলতে ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন। আমি এখানে স্পষ্টভাবেই বলব যে,যারা এখানে বরকতময় রাতের অর্থ ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন তারা এমন বড় ভুল করেন যা আল্লাহর কালাম বিকৃত করার মত অপরাধ। কারণ 
এক. কুরআন মাজীদের  আয়াতের তাফসীর বা ব্যাখ্যা সূরা আল-কদর দ্বারা করা হয়। সেই সূরায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন 
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ.
আমি এই কুরআন নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি জানেন লাইলাতুল কদর কি?লাইলাতুল কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য মালাইকা (ফেরেশ্তাগণ রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশে। এই শান্তি  নিরাপত্তা ফজর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।”[4]
অতএব বরকতময় রাত হল লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল বারায়াত নয়। সূরা দুখানের প্রথম সাত আয়াতের ব্যাখ্যা হল এই সূরা আল-কদর। আর  ধরনের ব্যাখ্যা অর্থাৎ আল-কুরআনের এক আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াত দ্বারা করা হল সর্বোত্তম ব্যাখ্যা
দুই. সূরা দুখানের লাইলাতুল মুবারাকার অর্থ যদি শবে বরাত হয় তাহলে  আয়াতের অর্থ দাড়ায় আল কুরআন শাবান মাসের শবে বরাতে নাযিল হয়েছে। অথচ আমরা সকলে জানি আল-কুরআন নাযিল হয়েছে রামাযান মাসের লাইলাতুল কদরে
 প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্‌ বলেন :
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ.
রামাযান মাস,যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন।”[5]
তিনঅধিকাংশ মুফাচ্ছিরে কিরামের মত হল উক্ত আয়াতে বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। শুধু মাত্র তাবেয়ী ইকরামা রহএর একটা মত উল্লেখ করে বলা হয় যে,তিনি বলেছেন বরকতময় রাত বলতে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতকেও বুঝানো যেতে পারে
তিনি যদি এটা বলে থাকেন তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত। যা কুরআন  হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে পরিত্যাজ্য।  বরকতময় রাতের দ্বারা উদ্দেশ্য যদি শবে বরাত হয় তাহলে শবে কদর অর্থ নেয়া চলবেনা
চারউক্ত আয়াতে বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা শবে বরাত করা হল তাফসীর বির-রায় (মনগড়া ব্যাখ্যা),আর বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা লাইলাতুল কদর দ্বারা করা হল কুরআন  হাদীস সম্মত তাফসীর। সকলেই জানেন কুরআন  হাদীস সম্মত ব্যাখ্যার উপস্থিতিতে মনগড়া ব্যাখ্যা (তাফসীর বির-রায়গ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই
পাচসূরা দুখানের  নং আয়াত  সূরা কদরের  নং আয়াত মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে,বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। সাহাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ),ইবনে কাসীর,কুরতুবী প্রমুখ মুফাচ্ছিরে কিরাম  কথাই জোর দিয়ে বলেছেন এবং সূরা দুখানের ‘লাইলাতুম মুবারাকা অর্থ শবে বরাত নেয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছেন
ইমাম কুরতুবী (রহঃতাঁর তাফসীরে বলেছেন  “কোন কোন আলেমের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহদ্বারা উদ্দেশ্য হল মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত) কিন্তু এটা একটা বাতিল ধারণা।
অতএব  আয়াতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহএর অর্থ লাইলাতুল কদর। শাবান মাসের পনের তারিখের রাত নয়
ছয়ইকরামা (রঃবরকতময় রজনীর যে ব্যাখ্যা শাবানের ১৫ তারিখ দ্বারা করেছেন তা ভুল হওয়া সত্ত্বেও প্রচার করতে হবে এমন কোন নিয়ম-
কানুন নেই। বরং তা প্রত্যাখ্যান করাই হল হকের দাবী। তিনি যেমন ভুলের উর্ধ্বে নন,তেমনি যারা তার থেকে বর্ণনা করেছেন তারা ভুল শুনে থাকতে পারেন অথবা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বানোয়াট বর্ণনা দেয়াও অসম্ভব নয়
সাতশবে বরাতের গুরুত্ব বর্ণনায় সূরা দুখানের উক্ত আয়াত উল্লেখ করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে  আকীদাহ বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে,শবে বরাতে সৃষ্টিকূলের হায়াত-মাউতরিয্-দৌলত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়  লিপিবদ্ধ করা হয়। আর শবে বরাত উদযাপনকারীদের শতকরা নিরানব্বই জনের বেশী  ধারণাই পোষণ করেন। তারা এর উপর ভিত্তি করে লাইলাতুল কদরের চেয়ে ১৫ শাবানের রাতকে বেশী গুরুত্ব দেয়। অথচ কুরআন  হাদীসের আলোকে  বিষয়গুলি লাইলাতুল কদরের সাথে সম্পর্কিত। তাই যারা শবে বরাতের গুরুত্ব বুঝাতে উক্ত আয়াত উপস্থাপন করেন তারা মানুষকে সঠিক ইসলামী আকীদাহ থেকে দূরে সরানোর কাজে লিপ্ত,যদিও মনে-প্রাণে তারা তা ইচ্ছা করেন না
আটইমাম আবু বকর আল জাসসাস তার আল-
জামে লি আহকামিল কুরআন তাফসীর গ্রন্থে লাইলালাতুন মুবারাকা দ্বারা মধ্য শাবানের রাত উদ্দেশ্য করা ঠিক নয় বলে বিস্তারিত আলোচনা করার পর বলেন : লাইলাতুল কদরের চারটি নাম রয়েছে,তা হল : লাইলাতুল কদরলাইলাতু মুবারাকাহলাইলাতুল বারাআত  লাইলাতুস সিক।[6]
লাইলাতুল বারাআত হল লাইলাতুল কদরের একটি নাম। শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের নাম নয়। ইমাম শাওকানী (রহ.) তার তাফসীর ফতহুল কাদীরে একই কথাই লিখেছেন।[7]
 সকল বিষয় জেনে বুঝেও যারা ‘লাইলাতুম মুবারাকা অর্থ করবেন শবে বরাত,তারা সাধারণ মানুষদের গোমরাহ করা এবং আল্লাহর কালামের অপব্যাখ্যা করার দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না

শবে বরাত নামটি হাদীসের কোথাও উল্লেখ হয়নি
প্রশ্ন থেকে যায় হাদীসে কি লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত নেইসত্যিই হাদীসের কোথাও আপনি শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত নামের কোন রাতের নাম খু্জে পাবেন না। যে সকল হাদীসে  রাতের কথা বলা হয়েছে তার ভাষা হল ‘লাইলাতুন নিস্ মিন শাবানঅর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত্রি। শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত শব্দ আল-
কুরআনে নেই,হাদীসে রাসূলেও নেই। এটা মানুষের বানানো একটা শব্দ। ভাবলে অবাক লাগে যে,একটি প্রথা ইসলামের নামে শত শত বছর ধরে পালন করা হচ্ছে অথচ এর আলোচনা আল-কুরআনে নেই। সহীহ হাদীসেও নেই। অথচ আপনি দেখতে পাবেন যে,সামান্য নফল ‘আমলের ব্যাপারেও হাদীসের কিতাবে এক একটি অধ্যায় বা শিরোনাম লেখা হয়েছে

ফিকহের কিতাবে শবে বরাত
শুধু আল-কুরআনে কিংবা সহীহ হাদীসে নেই,বরং আপনি ফিক্হের নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলো পড়ে দেখুনকোথাও শবে বরাত নামের কিছু পাবেন না। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বীনি মাদ্রাসাগুলিতে ফিক্হের যে সিলেবাস রয়েছে যেমন মালাবুদ্দা মিনহুনুরুল ইজাহকুদুরীকানযুদ্‌ দাকায়েকশরহে বিকায়া  হিদায়াহ খুলে দেখুন নাকোথাও শবে বরাত নামের কিছু পাওয়া যায় কিনাঅথচ আমাদের পূর্বসূরী ফিকাহবিদগণ ইসলামের অতি সামান্য বিষয়গুলো আলোচনা করতেও কোন ধরনের কার্পণ্যতা দেখাননি। তারা সূর্যগ্রহণ,চন্দ্রগ্রহণের সালাত সম্পর্কেও অধ্যায় রচনা করেছেন। অনুচ্ছেদ তৈরী করেছেন কবর যিয়ারতের মত বিষয়েরও। শবে বরাতের ব্যাপারে কুরআন সুন্নাহর সামান্যতম ইশারা থাকলেও ফিকাহবিদগণ এর আলোচনা মাসয়ালা-মাসায়েল অবশ্যই বর্ণনা করতেন
অতএব  রাতকে শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত অভিহিত করা মানুষের মনগড়া বানানো একটি বিদআত যা কুরআন বা হাদীস দ্বারা সমর্থিত নয়

তথ্যসূত্র :
[সূরা তাওবাহ
[]সূরা কামার৩৪
[]সূরা দুখান-
[]সূরা কাদর-
[সূরা আল-বাকারাহ১৮৫
[]আল জামে লি আহকামিল কুরআন

[]তাফসীর ফাতহুল কাদীর



0 Reviews